শেখ আশরাফুল ইসলাম 09 April, 2025 06:35 PM
মাত্র তিন অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ “বিদায়”। কিন্তু এই বিদায় যখন লাখো মানুষের অন্তর কাঁদায়, জাতির জন্য তৈরি করে যায় অপূরণীয় ক্ষতি; তখন এটিকে কেবল তিন অক্ষরের শব্দ মনে হয় না। “বিদায়” তখন মহাকাব্য। গত ৪ এপ্রিল (শুক্রবার) বেলা ১১টায় এমনই এক মহাকাব্যের ইতি টেনে রবের ডাকে সারা দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে শেষ হলো হাফেজ্জী হুজুরের প্রথম প্রজন্ম।
প্রবীণ আলেম, ক্বারী ও বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ ছিলেন জাতির আলোর মিনার। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান আলেম, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক রাহবার। উত্তম চরিত্র, সদ্ব্যবহার ও অতিথি পরায়ণ গুণের অধিকারী ছিলেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী। রাজনীতির মাঠে কিংবা দ্বীনের খেদমতে তার অসামান্য অবদান জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর হাতে গড়া আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী শৈশব কাল থেকেই উত্তম চরিত্র, সুন্দর ব্যবহার, বিনয় ধৈর্য্য ও উদার গুণের অধিকারী ছিলেন। উস্তাদ ও বড়দের প্রতি তিনি সবসময় ছিলেন শ্রদ্ধাশীল।
জন্ম পরিচয় :
ভারত উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ বুজুর্গ ও তওবার রাজনীতির প্রবর্তক হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ঔরসে ১৯৪৮ সালের ১০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক লালবাগ কিল্লার মোড়ের জীর্ণ কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী। হাফেজ্জী হুজুরের চার পুত্রের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। হাফেজ্জী হুজুরের অন্য ছহেবজাদাগণ হলেন যথাক্রমে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ (রহ.), মাওলানা ওবায়দুল্লাহ (রহ.), ও মাওলানা হাফেজ হামিদুল্লাহ (রহ.)।
বংশ পরিচয় :
বাংলাদেশে যে কয়েকটি বংশ প্রসিদ্ধ এবং মর্যাদার অধিকারী তারমধ্যে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর বংশ উল্লেখযোগ্য। হাফেজ্জী হুজুর যেমনই সর্বজন স্বীকৃত বুজুর্গ ছিলেন তেমনি তার পূর্বপুরুষগণও ছিলেন সুপরিচিত আলেম ও পীর দরবেশ। হযরত হাফেজ্জী হুজুর -এর বাবা মাওলানা ইদ্রিস (রহ.) ছিলেন সমাজের সুদক্ষ ও পরিচিত আলেম। তিনি উর্দু ও ফারসি ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। দাদা মাওলানা মুন্সী আকরাম উদ্দিন (রহ.) ছিলেন বালাকোটের শহীদ সৈয়দ আহমাদ বেরলবী (রহ.) -এর সুযোগ্য খলিফা।
মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর মা ছিলেন আরব বংশদ্ভূত। আরবের মক্কা নগরের সম্ভ্রান্ত খানদানের বিশিষ্ট আলেম ব্যক্তিত্ব হাফেজ তোহা মাক্কী ছিলেন মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর নানা। যিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের কোরআন প্রেমিক ও পরহেজগার ব্যক্তি।
শিক্ষাজীবন :
শিশুকাল থেকেই বিখ্যাত আলেম বুজুর্গ পিতা হাফেজ্জী হুজুর (রহ) -এর তালিম তারবিয়ত গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী। বাবা হাফেজ্জী হুজুরের কাছে শিক্ষাজীবনের প্রথম সবক গ্রহণ করেন। তারপর মায়ের কাছে কায়দা, আমপারা প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করার পর হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) -এর তত্ত্বাবধানে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় হিফজুল কুরআন সমাপ্ত করেন। লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়ায় কয়েক জামাত পড়ার পর ইলমে নববী অর্জনের লক্ষ্যে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমান পাকিস্তানের জামিয়া ইসলামিয়া বিননূরী টাউন মাদরাসায়। সেখানে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন এবং বড় বড় ইসলামী মনীষীদের সান্নিধ্য অর্জন করেন ও সোহবত প্রাপ্ত হন।
কর্মজীবন :
দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করার পর এদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামেয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী। পরবর্তীকালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া কামরাঙ্গীরচর মাদরাসায় খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। বাবা হাফেজ্জী হুজুরের রেখে যাওয়া প্রাণ প্রিয় প্রতিষ্ঠান জামেয়া নুরিয়ার সার্বিক কল্যাণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যান মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর রহ. ।
২০১৫ সালের ৬ আগস্ট জামিয়া নুরিয়ার মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করে অসুস্থতার পূর্ব পর্যন্ত সুচারুরূপে তা পালন করেন। মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী ১৯৯৬ সাল থেকে কাওরান বাজার আম্বরশাহ জামে মসজিদের প্রধান খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি নিজ জন্মভূমি লক্ষ্মীপুরে হযরত হাফেজ্জী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত ইশাআতুল উলুম লুধুয়া মাদরাসা, সাভার বলিয়ার পুর মাদরাসা, গাজীপুর জামিয়া মাসীহুল উলুম ও জামিয়া খালেকিয়া মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অনেক মসজিদ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও মুরব্বি ছিলেন।
দেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষাবোর্ডগুলোর সম্মিলিত সর্বোচ্চ অথরিটি আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ-এর সদস্য ও বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া (বেফাক)-এর সহ-সভাপতি ছিলেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী।
বিবাহবন্ধন :
হযরত হাফেজ্জী হুজুর তার ছোট পুত্র আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীকে কাওরান বাজার মাদরাসার প্রিন্সিপাল আম্বর শাহ শাহী জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা সাঈদ সাহেবের জ্যেষ্ঠ কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মাওলানা সাঈদ (রহ.) ছিলেন জাতীয় মসজিদের খতীব মাওলানা ওবাইদুল হক (রহ.) এর সহপাঠী।
আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর রাজনৈতিক জীবন
১৯৮১ সালে যখন খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী টগবগে যুবক। রাজনীতিতে হাফেজ্জী হুজুরের অংশগ্রহণ, খেলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক বিশ্বময় ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইরাক ইরান লিবিয়া আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সফরের আমন্ত্রণ আসতে থাকে। এক কথায় হযরত হাফেজ্জী ছিলেন তখনকার আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাবা হাফেজ্জী হুজুরের সকল কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী। হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমীরসহ কেন্দ্রীয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়ত নির্বাচিত :
২০১৪ সালের ২৯ শে নভেম্বর মজলিসে শুরার পরামর্শে সর্বসম্মতিক্রমে মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী আমীরে শরীয়তের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আমীরে শরীয়তের দায়িত্বে বহাল ছিলেন ।
হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব প্রদান : মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী উপমহাদেশের অন্যতম অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফ্ফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশ : কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে প্রতিষ্ঠিত এদেশের ওলামায়ে কেরামের প্রাচীন প্লাটফর্ম আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফ্ফুজে খতমে নবুওয়াতের সভাপতি মাওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদির ইন্তেকালের পর থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী।
১৯৯২ সালে ভারতের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদ আন্দোলনে এবং ১৯৯৪ সালে নাস্তিক তাসলিমা নাসরিনের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনসহ ২০০১ সালে ফতোয়া বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানে সম্মুখ সারিতে ছিলেন আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী।
কারাবরণ :বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে ইসলামবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় এরশাদ সরকারের আমলে কারাবরণও করতে হয় আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীকে।
আধ্যাত্মিক সাধনা :
মাওলানা আতাউল্লাহ হাফজ্জী যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) -এর নিকট আধ্যাত্মিক ইলম অর্জন করেন এবং হযরতের ইন্তেকালের পর কয়েকজন বড় বড় মনীষীদের সহচর্যে আসেন। তন্মধ্যে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) -এর নির্দেশে হযরত থানবী (রহ.) -এর আজল্লে খলীফা হযরত মাওলানা মসীহুল্লাহ খান (রহ.)- এর সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা আহমদ শফি (রহ.) ও হাফেজ্জী হুজুরের অন্যতম খলিফা শাইখুল হাদীস আল্লামা সুলাইমান নোমানী খেলাফত প্রদান করেন।
সন্তানাদি:
মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী (রহ.) ২ পুত্র ও ১ কন্যা রেখে গেছেন দুনিয়ায়। পুত্রদ্বয় হলেন হাফেজ মাওলানা মাহমুদুল্লাহ ও মাওলানা সানাউল্লাহ হাফেজ্জী এবং একমাত্র জামাতা হলেন মাওলানা মূসা বিন ইজহার।
শেষ বিদায় :
অবশেষে বর্ণাঢ্য জীবনের সফর সামাপ্ত হয় আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর। গত ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে দশটায় প্রিয় প্রতিষ্ঠান কামরাঙ্গীরচর জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়ায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় পিতা হাফেজ্জী হুজুরের পাশে।
তথ্যসূত্র : আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী (রহ.)-এর সুযোগ্য সন্তান মাওলানা সানাউল্লাহ হাফেজ্জী ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতী সুলতান মুহিউদ্দীন